চট্টগ্রামের নামকরন
চট্টগ্রামের
অন্য একটি নাম ইসলামাবাদ। প্রধান সমুদ্র বন্দর ও কর্ণফুলি নদী ঘিরে অত্র অঞ্চলে
গড়ে উঠেছে বাণিজ্য। তাই চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাধধানী বলা হয়ে থাকে। এটি বাংলাদেশের
দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। সমুদ্র, নদী, পাহাড় ও সবুজ বৃক্ষে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে
ঘেরা বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যে এই শহরকে প্রাচ্যের রাণী
হিসেবে খ্যাতি রয়েছে।
শত বছরের এতিহ্যময় চট্টগ্রামের ইতিহাস বড়ই
বিচিত্র। চাটগা-চট্টগ্রাম শব্দটি ছোট হলেও ইতিহাস বড় সুমধুর। অনেক চড়াই উৎড়াই
পেরিয়ে বৈচিত্রময় চট্টগ্রামের সৃষ্টি। চট্টগ্রাম ও চিটাগং এর নামকরণের বিষয়ে বহু
মত প্রচলিত রয়েছে। এ পর্যন্ত চট্টগ্রামের ৪০ এর উর্দ্ধে নাম পাওয়া যায়। প্রচীনকাল
থেকে বিভিন্ন শাসক বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম শাসন করের এবং তারা বিভিন্ন নামকরন
করেন। তম্মধ্যে- চট্টল, চাটিগাঁ, চৈত্যগ্রাম,
চট্টলা, চাতগাঁও, চিতাগঞ্জ, পুস্পপুর, চিতাগঞ্জ,
চাটিগ্রাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর এসকল নাম পাওয়া যায়- সুপ্রাচীনকাল থেকে
এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পরিব্রাজক, ভৌগোলিক এবং পন্ডিতগণের লিখিত বিবরণে, অঙ্কিত
মানচিত্রে। তাছাড়া বিভিন্ন শাসকগনের মুদ্রায় চট্টগ্রামকে বহু নামে আখ্যায়িত
করেছিলেন। প্রাচীন গ্রিক ও মিসরীয় ভৌগোলিকদের বর্ণনায় চট্টগ্রাম
অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের কিছু কিছু উল্লেখ পাওয়া যায়। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক স্যার ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মতে তা
সন্দ্বীপে সঙ্গে অভিন্ন। ল্যাসেনের মতে, পেন্টাপোলিস চট্টগ্রামেরই
ক্ল্যাসিক্যাল নাম।
তবে চট্টগ্রামের নামকরনের বিষয়ে ইতিহাসবিদের
উল্লেখযোগ্য মতামত তুলে ধরা হলো-
* ৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে চন্দ্রবংশীয়
আরাকান রাজা সু-লা-তাইং-সন্দুয়া (চুড় চন্দ্র সিংহ) এই ভুখন্ড জয় করেন, কিন্তু পথিমধ্যে যুদ্ধের
বিভিষীকা দেখে এই রাজার মনের অবস্থার পরিবর্তন হয়, তিনি
উত্তর দিকে অগ্রসর না হয়ে আরাকান ফিরে যান এবং ফিরে যাব্র পূর্বে একটি স্মারক
স্তম্ভ নির্মাণ করেন যেখানে শিলালিপিতে খোদাই করা হয় চেত-ত-গৌং যার অর্থ যুদ্ধ করা অনুচিত। ইতিহাসবিদদের মতে, এই চেত-ত-গৌং থেকেই
চিটাগং নামটির উৎপত্তি।
* ইতিহাসবিদদের মতে, একসময় আরব
বনিকেরা ব্যবসা- বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামকেই
প্রাধান্য দিতেন। তারা মনে করতেন, গঙ্গা নদীর শেষ সীমা হলো কর্ণফুলী নদী। তাই তারা গঙ্গার
সমাপ্তিস্থল হিসেবে এই ভূখন্ডের নামকরণ করেন শাৎ-আল-গঙ্গা।
এই শাৎ-আল-গঙ্গা থেকেই পরবর্তীক্রমে শাতগাং ও চিটাগং
নামের উৎপত্তি।
*চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় 'চাটি' অর্থ বাতি বা চেরাগ এবং গাঁও অর্থ
গ্রাম। এ থেকে নাম হয় ''চাটিগাঁও"। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা স্যার উইলিয়াম জোন্সের মতে, এ এলাকার
একটি ক্ষুদ্র পাখির নাম থেকে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি।
* ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম মোঘল
সম্রাজের অধীনে আসে। আরাকানদের
পরাজিত করে মোঘল সম্রাট এর নাম রাখেন ইসলামাবাদ। পরবর্তীতে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে মীর
কাশিম আলী খান ইসলামাবাদকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করেন।
পরে কোম্পানি এর নাম রাখেন চিটাগাং।
*চট্টগ্রামের বাঙালি বৌদ্ধ
সম্প্রদায়ের অভিমত এই যে, প্রাচীনকালে এখানে অসংখ্য
বৌদ্ধ চৈত্য অবস্থিত ছিল বলে এ স্থানের নাম হয় চৈত্যগ্রাম। চৈত্য অর্থ
বৌদ্ধমন্দির কেয়াং বা বিহার। এই চৈত্যের সঙ্গে গ্রাম শব্দ যুক্ত হয় বলে
চৈত্যগ্রাম নামের উদ্ভব হয়। পরবর্তীকালে চৈত্যগ্রাম নাম বিবর্তিত হয়ে চট্টগ্রাম
রূপ প্রাপ্ত হয়।
চতুঃগ্রাম: ব্রিটিশ আমলের গেজেটিয়ার লেখক ও'মলি সাহেবের মতে, সংস্কৃত চতুঃগ্রাম শব্দ থেকে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি। চতুঃ অর্থ চার। চতুঃ শব্দের সঙ্গে গ্রাম শব্দ যুক্ত হয়ে চতুঃগ্রাম হয়। চতুঃগ্রাম বিবর্তিত হয়ে চট্টগ্রাম রূপ প্রাপ্ত হয়।
চতুঃগ্রাম: ব্রিটিশ আমলের গেজেটিয়ার লেখক ও'মলি সাহেবের মতে, সংস্কৃত চতুঃগ্রাম শব্দ থেকে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি। চতুঃ অর্থ চার। চতুঃ শব্দের সঙ্গে গ্রাম শব্দ যুক্ত হয়ে চতুঃগ্রাম হয়। চতুঃগ্রাম বিবর্তিত হয়ে চট্টগ্রাম রূপ প্রাপ্ত হয়।
* চট্টগ্রামে চেরাগী পাহাড় চিনেনা এমন
মানুষ থাকলেও অধিকাংশ মানুষ এই পাহাড়ের সাথে পরিচিত। কথিত আছে ইসলাম ধর্ম প্রচারের
উদ্দেশ্যে আরব দেশ হতে সুফি সাধক, হযরত বদর শাহ
চট্টগ্রামে আসেন। তখন চট্টগ্রামের এই অঞ্চলটি ছিল জন-মানব শুন্য। জ্বীন-পরীদের ভয়ে
এই এলাকায় কোন মানুষ বসবাস করার সাহস পেতেন না। কিন্তু হযরত বদর শাহ সেখানে
পাহাড়ের উচ্চ চুড়ায় চেরাগ জ্বালিয়ে ইবাদ করতে থাকলে এক সময় জ্বিন-শয়তান বিতাড়িত
হয়ে লোক বসতি গড়ে উঠে। চেরাগের অন্য নাম হলো চাঁটি বা বাতি।
এই চাঁটির কারনে যেহেতু গন-বসতি শুরু হয়
সেই কারনে অত্র অঞ্চলের নাম হয় চাঁটিগা বা চাটগাঁ। সময়ের ক্রম ধারায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জনবসতি গড়ে
উঠায়ভাষার বিবর্তনে চাঁটিগা বা চাটগাঁও থেকেই উৎপত্তি হয় চাঁটগা, চট্টল,
চট্টলা বা চট্টগ্রাম।
তথ্যসংগ্রহে: মোহাম্মদ হারুন-উর-রশীদ
0 Comments